জলদাপাড়ার  দু’রাত্রি…(Holong Forest Bungalow, Jaldapara)

জলদাপাড়ার দু’রাত্রি…(Holong Forest Bungalow, Jaldapara)

ট্রেনটা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। সবাই উঠেই একটা সিট জোগাড় করার চেষ্টায় ব্যাস্ত। আমার উনিও একটা সিট ম্যানেজ করে আমায় ডাকাডাকি শুরু করেছেন। আমি কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দরজার কাছে। সিট ধরার তাড়া আমার নেই। আজ  আমার একটু অন্যরকমভাবে যাওয়ার ইচ্ছে। যাচ্ছি এন. জে. পি থেকে মাদারিহাট। এই রাস্তাটা আমার ভীষন প্রিয়। ছোটবেলা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা এক গল্প পরার পর থেকেই আমার খুব ইচ্ছে এরকম এক রাস্তায় পুর্নিমার রাতে মালগাড়ির পেছনে শুয়ে শুয়ে জঙ্গল আর আকাশ দেখতে দেখতে যাব। না, সে স্বপ্ন পূরনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আজ অন্তত নেই। আজ  আমি ট্রেনের দরজায় বসে বসে যেতে চাই। সব ছেলেদের যখন দেখি ওখানে বসে যেতে আমারও খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু লোকে কি ভাববে ভেবে কোনোদিন আর লজ্জা কাটিয়ে বসা হয়ে ওঠে নি। তবে আজ  আর লোকজনের কথা ভাবাচ্ছে না। কত্তামশাইও হাল ছেড়ে দিলেন। আর আমি ট্রেন ছাড়তেই খবরের কাগজ পেতে বসে পড়লাম। কয়েকজন যাত্রী আড়চোখে দেখল, কেউ কেউ গুনগুন, ফিসফাস করল। আমার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই একটুও।

ভিড়ের  ভেতর থেকে সাবধান বানীও কানে এল – ‘দিদি ওখানে বসবেন না। একটা বিপদ ঘটে গেলে কিছু করার থাকবে না।’

কথাটা যে মিথ্যে নয়, আমিও বুঝি। কিন্তু বাকিদের কি করে বোঝাই যে ওখানে বসার যে রোমাঞ্চ আছে তাই যে  হাতছানি দিয়ে ডাকে আমায়। তাই বসে বসেই উত্তর দিলাম-

 ‘সাবধানে ধরে বসেছি দাদা, একটু পরই নেমে যাব। কিচ্ছু হবে না।’

On the way to Madarihat
মাদারিহাটের পথে…

যদিও খুব তাড়াতাড়ি নামছি না আমি। এন. জে. পি থেকে মাদারিহাট ১১৫ কিলোমিটার রাস্তা। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা, জঙ্গল আর চা বাগানের মাঝখান দিয়ে এই ট্রেন রুট। আর তার রূপ উপভোগ করার জন্যই তো লোকাল ট্রেনে আসা। ট্রেন চলছে ধীর গতিতে, আপনমনে। আমি পা ঝুলিয়ে বসে আছি ট্রেনের দরজায়। মিস্টি হাওয়া আমার চোখ, মুখ, চুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছোট বড় চা বাগানগুলো হাসিমুখে আমাদের টাটা করে পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে আর আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের পথে। একটু পরেই ট্রেন ঢুকলো জঙ্গলে মোড়া রাস্তায়। চৈত্রের শেষ, তবু উত্তরে এসেছি বলেই হয়তো বাতাসে আগুন নেই। সেগুন গাছের ঘন পাতার ছায়ায় ঢাকা রাস্তা। ট্রেন ঢুকলো টানেলের ভেতর। এক মুহুর্তে অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেল চারিদিক। আবার মুহুর্তে আলো ছিঁড়ে ফেলল অন্ধকারের মায়াজাল। এইভাবে আলো আঁধার আর সেগুন বনের সাথে খেলতে খেলতে পৌঁছে গেলাম মাদারিহাট।

মাদারিহাট ষ্টেশন থেকে ৭ কিলোমিটার রাস্তা জলদাপাড়া। ষ্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া পেতে অসুবিধে হয় না। জঙ্গলের ভেতরে থাকার একমাত্র জায়গা হল ফরেস্ট বাংলো ‘হলং’। অনেক আগে থেকে  বুকিং করতে হয়। এছাড়া জঙ্গলের বাইরেও থাকার বেশ কিছু জায়গা আছে। আমাদের হলং এ বুকিং আছে দু’দিনের। মাদারিহাট থেকে হলং যাবার পথে ঠিক জঙ্গলে ঢোকার মুখে একটা হোটেলে মধ্যান্যভোজনও সেরে নিলাম। বড় বড় কাঁসার থালা-বাটি-গ্লাসে সুন্দর সাজানো খাবার এল। একটা আলাদা  প্রাচীন আভিজাত্য আছে পরিবেশনায়, খাবারও সুস্বাদু।

Holong_Jaldapara
হলং বাংলো

  হলং এ পৌঁছে ভীষণ অবাক হলাম। যে হলং-এ এক মাস আগে থেকে বুকিং না করলে ঘর পাওয়া যা না, সে হলং ফাঁকা। কোথাও লোকজন নেই। শুধু manager আর কর্মচারীরা বসে আছে। আমাদের ছাড়া বাকি সব গুলো ঘর একসাথে বুক ছিলো ভুটানের কোন পরিবারের। কিন্তু কোন একটা কারণে তারা শেষ মুহুর্তে আসতে পারেন নি। আর ক্যান্সেলও করাতে পারেন নি। তাই বাকি সবগুলো ঘর ফাঁকা। এমন জঙ্গলের ভেতর এমন ফাঁকা পরিবেশ পাবো ভাবতে পারিনি। তাই বেশ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।

সল্টপিটের ঠিক সামনের সবচেয়ে ভালো ঘরটায় আমরা ছিলাম। বিশাল জানালা, খুললেই সামনে সল্টপিট। বাংলো আর সল্টপিটের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে  হলং নদী। নানা রকম পাখি সল্টপিটে। দুটো ময়ূরও নেচে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। কিছু বানর খেলা করছে। ফুলে ফুলে ভরে আছে বাংলোর চারিদিক। সব মিলিয়ে এক মন ভাল করে দেওয়া পরিবেশ। ঘরে ঢুকতেই আমাদের স্বাগত জানালো একটা ‘তক্ষক’। বাথরুমের দরজার উপর বিশ্রামে মগ্ন সে। লোকজন কে ভয়ই নেই তার! 

Holong_Jaldapara
বাংলোর গেটে ফুলের বাহার

বাংলোর আশেপাশে মাঝে মাঝেই জংলি জানোয়ার ঢুকে পরে তাই বিকেলের পর আশেপাশে হেঁটে বেড়ানোর অনুমতি নেই। জঙ্গলের যে দিকটায় মাহুতদের বস্তি আর পিলখানা আছে শুধু সেদিকটায় যাবার অনুমতি আছেে। কিন্তু শর্ত একটায়- অন্ধকারের আগে ফিরে যেতে হবে। অগত্যা আমরা  সেদিকেই চললাম। পিলখানার সামনে যখন পৌঁছালাম তখন আলো কমে এসেছে। দেখলাম বেশ ক’টা কুনকি হাতি বাঁধা আছে সেখানে। তারপর ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব শুনতে শুনতে আমরা নদী বরাবর আরও এগিয়ে চললাম। ধীরে ধীরে আলো আরও কমে এল। চারপাশে একটা গা ছমছমে ভাব। আমাদের অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরে যেতে বলা হয়েছিল কিন্তু ঘড়ির কাঁটার দিকে আর খেয়াল রাখা হয়নি। একটু দেরিই করে ফেলেছি আমরা। তাই ফিরতি পথে হাঁটা শুরু করলাম। একটু এগোতেই আঁধার ঘনিয়ে এল। জংলি রাস্তায় শুধু আমরা দুজন। এই নিঝুম জনমানবহীন পরিবেশে ঝিঁঝিঁর ডাক একটা গা ছমছমে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমরা হাঁটার গতি বাড়ালাম। আশেপাশে ঝোপেঝাড়ে  জোনাকিরা যেন সাঁঝবেলার বাতি জ্বালিয়ে গেছে। বাংলোর কাছাকাছি প্রায় চলে এসেছি এমন সময় হঠাৎ কোন ফাঁক থেকে কোন এক পাখি ভয়ংকর ‘কা…’ ‘কা…’ ডাকতে লাগলো আর অমনি ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আরও কত কত পাখি সেই আতঙ্কিত ‘কা…’ ‘কা…’ চিৎকারে ভরিয়ে তুলল চারিপাশ। সে ডাকে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। যেন অজান্তে কোন ভৌতিক জগতে চলে এসেছি আমরা। আলো আঁধারিতে সব কিছু কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। সোজা রাস্তাটা কেমন যেন গুলিয়ে গেল। জানি বাংলোর খুব কাছেই পৌঁছে গেছি কিন্তু ঠিক কোন্ দিকটায় আমাদের বাংলো বুঝতে পারছি না। এদিকে চারিদিকের এই কা কা চিৎকারেই দম বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এসেই শুনেছি এক ক্ষ্যাপা গন্ডার নাকি কাল থেকে বাংলোর আশেপাশে ঘুরছে। মনে পড়তেই বুকের ভেতর ঢিবঢিব করতে লাগলো। এরই মাঝে সামনে একটা খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। আস্তে আস্তে আওয়াজটা যেন  আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এক মুহুর্তে  একটা শীতল অনুভূতি বয়ে গেল যেন সারা শরীরে।

একটু পরই দেখতে পেলাম টর্চ হাতে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। আমাদের দেরি দেখে খুঁজতে বেড়িয়েছেন বাংলোর এক কর্মী।  উনাকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। উনি বললেন চারিপাশের যে পাখির ডাকে আমরা আতঙ্কিত হয়েছিলাম ওটা আসলে ময়ুরের ডাক। বই এ পড়েছিলাম  যে ময়ুরের ডাক কর্কশ  কিন্তু এত সুন্দর পাখির যে এত ভয়ানক ডাক হতে পারে সে অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়নি।

Jaldapara_West Bengal
পেঁচা আর পেঁচানি

ফেরার একটু পর থেকেই শুরু হল এক গণ্ডারের দাপাদাপি। আমাদের ঘরের খোলা জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম যে গন্ডারটা জানালার ঠিক নিচে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই আমার কাছের থেকে প্রথম গন্ডার দেখা, তাই উন্মাদনাটাও একটু বেশি। উন্মাদনায়  নিজের বুকের ভেতরের ঢিপ ঢিপ আওয়াজ নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছিলাম। সে মহাশয় কিছুক্ষন বাংলোর চারিপাশে ঘোরাফেরা করে আবার অন্ধকার জঙ্গলে কোথায় মিলিয়ে গেলেন। সল্টপিটেও দু’একজন অতিথির দেখা মিলছে মাঝে মাঝে।

রাতে জম্পেশ খাইদাই হল। হলং এর রাঁধুনির রান্নার হাতটা অনবদ্য। রাতের খাবার পর আমরা খোলা জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক, পাতার খসখসানি, আকাশে হলদে চাঁদ নিয়ে রহস্যের যেন জাল বিছিয়েছে রহস্যময়ী জঙ্গল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে আসা টুকরো টুকরো চাঁদের ছটায় যে আলো আঁধারি সৃষ্টি হয়েছে তা জঙ্গলের রহস্যকে যেন শত সহস্র গুন বাড়িয়ে তুলেছে। সামনের সল্টপিটটা আবছা আলোতেও চোখে পরছে স্পষ্ট। একটু পরেই সল্টপিটে লবন খেতে এল এক বাইসন, তার পিছু পিছু আরও দু’টো। রাত আরও একটু বাড়লে এল এক বিশালাকার বুনো দাঁতাল। গন্ডারের দেখা মিলছে একটু পর পরই। এইভাবেই আনাগোনা চলতে থাকলো রাতভোর।

 

Elephant Safari_Holong
হাতির পিঠে যাত্রা শুরু

পরদিন ভোরে ৬টার সময় আমাদের Elephant Safari । জঙ্গলের ভেতর না থেকেও শুধু   safari করা যায়। তবে যারা হলং এ থাকে তাদের আগে সুযোগ দেওয়া হয়। সক্কাল সক্কাল উঠে ঝটপট রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরলাম। হাতির পিঠে ওঠার অভিজ্ঞতাও আমার সেই প্রথম। বেশ মজা লাগছিলো। মনে হচ্ছিল যেন রাজ সিংহাসনে বসে আছি আমি। আমাদের হাতির নাম ছিল লক্ষ্মী। মাহুতও খুব ভাল মানুষ। তার সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একসাথে তিনটে হাতি আস্তে আস্তে ঢুকে পরল গভীর জঙ্গলে। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে রাজার চালে চলছে তারা। আশেপাশের জংলী লতা আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এক অকৃত্রিম বন্য পরিবেশের মাঝে আমরা। চোখে পড়ল ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক গন্ডার। বানর এ ডাল ও ডাল লাফলাফি করে বেড়াচ্ছে। রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাল দুটো জংলী শুয়োর। একটু এগোতেই আবার গন্ডার। ঘাস খেতে এতই মগ্ন যে মাথা উঁচু করে একবার দেখেই আবার ঘাস খেতে লাগলো। এখানের প্রকৃত বাসিন্দা এরাই। সারা পথে অনেকবারই দেখা পেলাম গণ্ডারের। এভাবে এত কাছ থেকে বন্য খোলা পরিবেশে এইসব প্রানীদের দেখা – এ যেন এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

ফিরে এসে সারাদিন সল্টপিটে গন্ডার, ময়ুর, বানর ও নানারকম পাখিদের আনাগোনা দেখেই সময় কেটে গেল। সল্টপিটে লবন দেবার সময় বনকর্মীদের সাথে নদী পেরিয়ে আমরাও চলে গেলাম ওপারে। কিভাবে লবন দেয় দেখলাম। শুনলাম অনেক গল্প। আমাদের প্রাক্তন এক মুখ্যমন্ত্রিও নাকি লবন দেবার সময় কর্মীদের সাথে এই সল্টপিটে এসেছিলেন। এখানে VVIP লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাই বুকিং পেতে অনেক সময়ই সমস্যা হয়। এর উপর আজকাল নাকি জঙ্গলে চোরা কারবারিদের দৌরাত্ম খুব বেড়েছে। জঙ্গলের ভেতর বেটারির গাড়ি করে ঘোরানোর ব্যাবস্থা ছিলো আগে তা আপাদত বন্ধ। চোরাকারবারিরা নাকি ওই ঘোরানোর সুযোগ নিয়ে জঙ্গলের রাস্তাঘাট চিনে যাচ্ছে। খুব খারাপ লাগলো শুনে জঙ্গলের প্র্রকৃত বাসিন্দারাই আজ জঙ্গলে নিরাপদ নয়। আর তাদের এই নিরাপত্তাহীনতার কারণ মানুষ নামক সবচেয়ে বুদ্ধিমান এক জাতি এটা ভেবেই লজ্জিত বোধ করলাম। নিজেকে যেন এদের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছিল।

Saltpit_Jaldapara
সল্টপিটে লবন দেওয়া হচ্ছে।

বিকেলে সল্টপিটের সামনে হলং নদীর ধারে গিয়ে বসলাম। একঝাঁক টিয়া সল্টপিটের পাশে এসে বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে। এভাবেই চলছে তাদের খেলা। আরও নানা ধরনের পাখির যেন মেলা বসেছে। একটু পর আস্তে আস্তে অন্ধকার হতেই আবার সেই ময়ুরের ভয়ঙ্কর কাকা চিৎকারে ভোরে উঠলো চারিদিক। অদ্ভুত গা ছমছমে অনুভূতি জাগায় এই ডাক। মুহুর্তে দেখতে পেলাম ছুটে নদীর এপাশ থেকে ওপাশের জঙগলে ঢুকে গেল একটা জন্তু। ঠিক খেয়াল করা গেল না ওটা কি কিন্তু গায়ে ছোপ ছোপ ছিল। এখানে নাকি কিছুদিন আগেই চিতাবাঘ দেখা গিয়েছে। সেটাও হতে পারে আবার বাঘরোলও হতে পারে। তবে আমাদের বাইরে বসে থাকাটা যে আর নিরাপদ নয় সেটা বোঝা গেল। আমাদের ভেতরে চলে যেতে বলা হলো।

Holong_jaldapara_Madarihat

আজ বিকেলের দিকে আরেকটা family এসেছে তাই আজ আর আমরা হলং এ একা নই। ভেতরে গিয়ে তাদের সাথে জমিয়ে আড্ডা হল। সকলকে এত তাড়াতাড়ি আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা মনে হয় শুধু বাঙালীদেরই  আছে। আর আড্ডার একছত্র অধিকার তো আমাদেরই। তাই খুব তাড়াতাড়িই আমরা দুটো পরিবার যেন একটা পরিবার হয়ে গেলাম। তারা শিলিগুড়ির বাসিন্দা। শুধু এক রাতের জন্যই এসেছেন। কালই ফিরে যাবেন। ডিনার সেরে নিয়ে আজ আমরা সবাই একসাথে বসে পরলাম  রাতের অন্ধকারে সল্টপিটে আসা অতিথিদের দেখার জন্য। আজ সারারাতও চলল আগের রাতের মতো খেলা।

 

 আগেরদিন হাতির পিঠে উঠে এত মজা পেয়েছিলাম যে পরদিন সকালে আবার সাফারি বুক করেছিলাম। পরদিন ভোরবেলা আবার লক্ষ্মীর পিঠে চেপেই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তবে আজ আমরা বাকি হাতিদের সাথে না ঘুরে অন্য রাস্তা ধরলাম। মাহুত ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল কালই। আজ সে আমাদের বাঁধা ধরা রাস্তায় না নিয়ে গিয়ে আরও গভীর জঙ্গলে নিয়ে গেল। গভীর জঙ্গল পেরিয়ে ভেতরে এক অসাধারন চারণভূমিতে পৌঁছালাম আমরা। উলু বনে ঢাকা এক ছোট্ট জলার মাঝে  ঝোপে আড়াল করে দাঁড়াল আমাদের লক্ষ্মী। সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা বিস্তীর্ণ চারণভূমি। চারিদিকে সাদা সাদা ঘাস ফুলে ভরে আছে। এক দল হরিন চড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। পুকুরের জলে আরাম করছে এক গন্ডার আর তার সঙ্গী সাথিরা মনের সুখে ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। নানা রকম পাখি আশেপাশে। এক জলার ধারে একটা বাচ্চা হাতি তার মা হাতির সাথে খেলা করছে। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সম্বর হরিণও চোখে পড়ল।

Jaldapara_West Bengal

 সাফারি শেষে ফিরে এলাম বাংলোতে। একটুপর কাজ সেরে মাহুত এল আমাদের তার সাথে তার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। পাশেই একটা গ্রামে বাড়ি তার। হাতে বিশেষ কোন কাজ নেই দেখে আমরাও বেড়িয়ে পরলাম তার সাথে। জঙ্গলের এক ধার দিয়ে চলে গেছে মেঠো রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমরা চলতে লাগলাম। একটু পরই একটা ছোট্ট নদী। স্বচ্ছ জল বয়ে চলেছে কুলকুল করে। জল এত স্বচ্ছ যে নদীর বুকের পাথরগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জলে ভেসে বেড়াচ্ছে হরেক রকম পাখি। বানরে ছেয়ে আছে জায়গাটা। নদীর ওপারেই একটা সুন্দর ছোট্ট গ্রাম। কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম গ্রামে। বাড়িটিও বেশ পরিপাটি। মাঝখানে বড় উঠোন, একপাশে একটা গোলাঘর। পাশে ঢিবি করে রাখা আছে জমি থেকে সদ্য কেটে আনা ফসল। বাড়িতে চাষ হয় রেশম কীট। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম কিভাবে রেশম কীট থেকে রেশম সুতো তৈরি হয়। তারপর আবার সেই মেঠো পথ ধরে ফিরে এলাম বাংলোতে।

আজ দুপুর পর্যন্ত আমরা হলং এর অতিথি। তারপর ফিরতে হবে নিজেদের আস্তানায়। তাই যাবার আগে দেখা করে এলাম হলং নদীর সাথে। ছুঁয়ে এলাম তার স্বচ্ছ শীতল জল। বিদায় জানালাম খেলে বেড়ানো মাছেদের, উড়ে বেড়ানো পাখিদের। আমরা ফিরে যাচ্ছি। আবার কখনও আসা হবে কিনা জানিনা তবু কিছু মুহুর্ত, কিছু অনুভূতি হারায় না, থেকে যায় চিরকাল। তাই আমাদের সাথে না এসেও যেন আমাদের পাশেই পাশেই চলতে থাকলো সেই সব মুহুর্তরা… সেই মেঠো রাস্তা… সেই হলং নদী… সেই হলদে চাঁদ…

Jaldapara_West Bengal

কিভাবে যাবেন- মাদারিহাট ষ্টেশন থেকে জালদাপাড়া মাত্র ৭ কিমি পথ। স্টেশন থেকে গাড়ি পেতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু সমস্যা যে এই স্টেশনে শুধুমাত্র লোকাল ট্রেনই দাড়ায়। আমরা এন. জে. পি থেকে লোকাল ট্রেনে এসেছিলাম। ওই রাস্তাটা খুব সুন্দর কিন্তু সময় একটু বেশি লাগে। মেইল বা এক্সপ্রেস ট্রেনে আসলে নামতে হবে বীরপাড়া বা হাসিমারা স্টেশনে যা জলদাপাড়া থেকে ২০ কিমি দূরে। সেখান থেকে গাড়ি করে জলদাপাড়া।

কোথায় থাকবেন- হলং টুরিস্ট বাংলোতে বুকিং পেলে সবচেয়ে ভাল। এটি জঙ্গলের ৭ থেকে ৮ কিমি ভেতরে অবস্থিত। তাই এখানে থাকলে জঙ্গলকে উপভোগ করতে পারবেন ভালো করে। এটি West Bengal Tourism Development Corporation Ltd. এর অধীনে। হলং এ ঘর পেতে ১২০ দিন আগে বুক করতে হবে। বুক করতে পারেন এই লিঙ্ক থেকে।

এছাড়াও West Bengal Tourism Development Corporation Ltd এর অধীনে আছে অরণ্য টুরিসম প্রোপার্টি (+91- 9733008795) যা আগে টুরিস্ট লজ হিসেবে পরিচিত ছিল। জঙ্গলের কাছাকাছি বেশ কিছু থাকার ভালো জায়গা আছে। সেগুলিও দেখতে পারেন। এরমধ্যে জলদাপাড়া জঙ্গল ক্যাম্প , হলং ইকো রিসোর্ট, লোকনাথ ইকো ভিলেজ রিসোর্ট (+91 87681 15249) অন্যতম।

Jaldapara_West Bengal

কি দেখবেন- জঙ্গলকে উপভোগ করুন। জলদাপাড়া গন্ডারের জন্য বিখ্যাত। গন্ডারের সাথে সাথে দেখা পেতে পারেন হরিণ, হাতি, বাইসন, ময়ুর ও অন্যান্য অসংখ্য পশুপাখির। মনে রাখবেন জঙ্গলে পশুপাখির দর্শন পাওয়াটা কিন্তু কারও হাতে নেই, পুরোটাই নির্ভর করে ভাগ্যের উপর।

এলিফ্যান্ট সাফারি হয় হলং এর পাশ থেকে। অবশ্যই করুন। হলং এ না থাকলেও বুক করা যায় এই সাফারি কিন্তু যারা থাকে তাদের আগে সুযোগ  দেওয়া হয়। এছাড়া বেটারির গাড়ি করে জঙ্গল ঘোরানোর ব্যবস্থা আছে। ভাল লাগবে।

জঙ্গলের বাইরে জলদাপাড়া মিউজিয়াম আছে, দেখতে পারেন।

জলদাপাড়া থেকে চিলাপাতাও ঘুরে আসা যায়।

Recent Posts:

Moon Ray

A traveller with soul of a Nomad

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.