হঠাৎ মনটা কেমন উত্তরবঙ্গ উত্তরবঙ্গ করে উঠলো আর আমিও ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। শেষ মুহূর্তে ট্রেনে waiting List 2 টিকিট পেলাম। ভেবেছিলাম অন্তত RAC হয়েই যাবে। কিন্তু হল না। কপাল মন্দ বুঝি একেই বলে। waiting 1A এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আসা ছিলো টিটিকে বলে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। কিন্তু সরস্বতী পুজা আর শনি রবি মিলে এমন সুন্দর ছুটিটা পড়েছিল যে কেউ আর ছুটিটা হাত ছাড়া করতে চায়নি, বেড়িয়ে পড়েছে নিজের নিজের গন্তবে। অগত্যা জায়গা হল বাথরুমের সামনের ফাঁকা জায়গায়। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত। তবুও ঘুরতে যাবার উন্মাদনায় কোনো কিছুই যেন মন্দ লাগছিল না। বসে বসেই কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম, সে খেয়াল নেই।
সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম আলিপুরদুয়ার। যাবার ইচ্ছে বক্সাফোর্ট। হাল্কা শীতের সকালে অচেনা স্টেশনের বাইরে চায়ের খুপড়িতে চুমুক দিতে দিতে, টুকটুক করে খোঁজখবর নিয়ে নিলাম। তাড়াহুড়োই আসা, তাই বিশেষ খোজখবর নিয়ে ওঠা হয়নি। আলিপুরদুয়ার ষ্টেশন থেকে সান্তালাবাড়ি/সান্ত্রাবাড়ি খুব বেশি দূর নয়। ২৫ কিমি মত। নিজে ভাড়া গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। সেখান থেকে বক্সাফোর্ট ৫ কিমি পথ। একটা অটো ভাড়া করে বেড়িয়ে পরলাম সান্তালাবাড়ির পথে।
শহর থেকে বেরিয়ে রাস্তা ছুটেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। বড় সুন্দর সে রাস্তা। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় জঙ্গল হল এই বক্সার জঙ্গল। নানা প্রজাতির গাছপালা, অর্কিড, ঘাস ও জলজ উদ্ভিদ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বাস এ জঙ্গলে, যারমধ্যে এশিয়ান টাইগার, হাতি, বাইসন, সম্বর, কাঠবেড়ালি, বন্য শুকর উল্লেখযোগ্য। সাল, শিমুল, গামার, বন চাঁপা ইত্যাদি গাছ দিয়ে পূর্ণ এ অঞ্চলে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি ছাড়াও সুন্দর রঙিন রঙিন প্রজাপতির দেখা মিলে বছরের বিভিন্ন সময়ে। পাখিপ্রেমীদের কছে এ যেন এক স্বর্গরাজ্য।
বক্সাফোর্ট বক্সা টাইগার রিসার্ভের ভেতর ২৮৪৪ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। সান্তালাবাড়ি থেকে ফোর্টের রাস্তায় ৩কিমি ভেতরে ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। বাকি ২কিমি হাঁটা পথ। তবে আমার পুরো রাস্তাটায় হেঁটে যাবার ইচ্ছে। জঙ্গলে না হাঁটলে ঠিক তার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। জঙ্গলে ঢোকার মুখে গেটে guard এর খাতায় entry করে গাইড নিয়ে ঢুকতে হয়। আজকাল tourist -দের গাইড ছাড়া ঢুকতে দেওয়া হয় না। এটা নতুন চালু হয়েছে। আমার গাইড নিয়ে যাবার একটুও ইচ্ছে ছিল না। নিজের মত ধীরে সুস্থে হাঁটতে পারব না তবে। guard নিজেই প্রস্তাব দিল গাইডের বদলে লোকাল porter নেওয়া যেতে পারে। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। যদিও আমার rucksack আমি নিজেই বইতে পারতাম। ভাবলাম অন্তত গাইডের তাড়া খেতে হবে না। আমার মাল বওয়ার জন্য দৌড়ে এল পনেরো কি ষোল বছরের এক কিশোর, নাম রোহন। ওকে দিয়ে ব্যাগ বওয়ানোর কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না, তাই guard এর চোখের আড়াল হতেই ওর হাতে ওর প্রাপ্য টাকা গুঁজে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বললাম। ভাবলাম, এই সুন্দর রাস্তায় একা একা পাতাদের গান শুনতে শুনতে ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাব। ও টাকাটা নিল কিন্তু ব্যাগটা কিছুতেই ফেরত দিল না। ‘যদি জঙ্গলে আমি কোন বিপদে পরি’ সেই চিন্তায় সে আমায় ছেড়ে যেতে রাজি হলো না। আজকাল যেখানে সুযোগ পেলেই মানুষ মানুষকে ঠকাতে ব্যস্ত সেখানে এই সব পাহাড়ি সহজ সরল সৎ মানুষজনের জন্যই আজও পৃথিবীটা এত সুন্দর আছে। আমি আর আপত্তি না করে হাঁটতে লাগলাম।
জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সরু ছায়াঘেরা রাস্তা চলে গেছে। গাছের সাথে বাতাসের খেলা চলছে। সো সো শব্দ হচ্ছে তারই। শীতের আমেজটা কমে এসেছে। বসন্তের গন্ধ আকাশে বাতাসে। বসন্তের রঙ লাগতে শুরু করেছে পাতাদের গাঁয়ে। বসন্ত-বাতাস গাছেদের সাথে বেঁধেছে বসন্তের গান। নিস্তব্ধ রাস্তায় সেই গানই মন ভোলায় আমার। মনটা কেমন উদাস বাউল হয়ে গেছে। এমন দিনে কেমন যেন নিজেকে বড় একা লাগে, অসহায় লাগে। ইচ্ছে হয় ওই জঙ্গল আর পাহাড়ের খাঁদে কোথাও হারিয়ে যাই, ঘর ছেড়ে ঘর বাঁধি গহন বনে। সবার থেকে দূরে, সবার চোখের আড়ালে। ‘একাই থাকবো, একাই দুটো ফুটিয়ে খাবো।’ দু’চোখ ভরে শুধু প্রকৃতির শোভা দেখবো আর নিস্তব্ধতার সাথে কথা বলব। এসব ভাবতে ভাবতে চলতে লাগলাম। ভাবনার জালে আটকে নিমিষে যেন ৫ কিমি রাস্তা ফুরিয়ে এল।
সকালে আলিপুরদুয়ার ষ্টেশনের বাইরে হাল্কা টিফিনের পর বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি। এখন আমার ইঞ্জিনে একটু তেল দরকার। তাই ফোর্টের একটু আগে বক্সা বাজারে স্টেশনারি দোকান থেকে বিস্কুট, চিপস কিনে পেটে চালান করলাম আমি আর রোহন। আস্তে আস্তে আলাপ জমলো ওর সাথে। জানলাম, বক্সা বাজারের কাছেই ওর বাড়ি। সান্তালাবাড়ি গিয়েছিলো গরুর খাবার আনতে। ওখানেই কোন এক মিশনারি স্কুলে ক্লাস নাইনে পরে। ক্লাসে first হয়। ফাদার নাকি ওকে খুব ভালবাসে। স্কুল ফুটবল টিমের কাপ্টেন এই ছেলেটি খেলা-অন্ত-প্রান। এখানে থেকেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের খবরাখবর রাখার চেষ্টা করে।
কথায় কথায় চললাম ফোর্টের দিকে। ফোর্টের সামনে একটি বিশাল ফুটবল মাঠ। তারই পাশ দিয়ে উঠে গেছে ফোর্টের সিঁড়ি। সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠে এলাম। এই ফোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। মনে করা হয়, প্রথম কুচরাজ্, সঙ্গলদ্বীপ এটি তৈরি করেন। পরবর্তীতে কুচরাজের সাথে ভুটানের রাজার বিরোধ বাঁধে এই দূর্গ নিয়ে কারণ এটি ছিল তিব্বত হয়ে ভূটান যাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। ফলস্বরুপ এই দুর্গ দখল করে নেয় ভুটানের রাজা। উপায় না দেখে কুচরাজ ইংরেজদের আমন্ত্রন জানায় এই দুর্গের দখল নেবার জন্য। ইংরেজ বাহিনীও এই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। সৈন্য পাঠিয়ে দখল নেয় এই দুর্গের। এরপর ভুটান-ইংরেজ যুদ্ধের সময় ‘সিঞ্চুলা চুক্তি’ অনুসারে ১৮৬৫ সালের ১১ই নভেম্বর ভুটানের পক্ষ থেকে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা কাঠ ও বাঁশের তৈরি এই দুর্গকে পাথর দিয়ে পুনর্নির্মাণ করে। ১৯৩০ সালে ইংরেজরা এখানে একটি নির্বাসন কেন্দ্র ও কারাগার তৈরি করে। বলা হয়, দুর্গমতা ও ভয়াবহতার দিক থেকে আন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই ছিল এর স্থান। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর সমিতির অনেক বিপ্লবীকে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কথিত আছে, অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামির সাথে নেতজী সুভাসচন্দ্রও কিছুদিন এখানে বন্দী ছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে চীনের সাথে তিব্বতের দ্রেপুঙ্গ মনেস্ত্রির ঝামেলার সময় বহু তিব্বতি সন্যাসি শরণার্থী হিসেবে এখানে আস্তানা গড়ে তোলে যাদের পরে পুনর্বাসন দেওয়া হয় কর্ণাটকে। বড় মন খারাপ লাগলো এমন এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গার কোনো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই দেখে। ভেঙে চুড়ে নষ্ট হছে এমন মূল্যবান সম্পদ।
বক্সাফোর্টের কাছেই বক্সা মিউজিয়াম। কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থাও আছে। ভেবেছিলাম ওখানেই থাকবো। কিন্তু রোহন বললো আরো ৪/৫ কিমি উপরে পাহাড়ের চূড়ায় একটা খুব সুন্দর গ্রাম আছে, নাম লেপচাখা। সেখানে নাকি থাকার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। তাই এখানে না থেকে উঠতে লাগলাম আরও উপরে। এই রাস্তা একটু পাথুরে। বড় বড় পাথুরে ধাপ। অল্প হেঁটেই হাঁপিয়ে পড়ছি। কিন্তু প্রকৃতি বড় সুন্দর। জঙ্গল আরও ঘন। রাতের অমন বসে বসে আসার ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দিচ্ছে প্রকৃতির অপরূপ শোভা।
বক্সাফোর্ট থেকে লেপচাখা যেতে হয় তাশিগাও হয়ে। তাশিগাও রোভার্স পয়েন্ট-রূপমভ্যালী ট্রেক রুটের সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় আবস্থিত এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। বক্সাফোর্ট থেকে রোভার্স পয়েন্ট ট্রেক ৪ কিমি পথ। ৪৫০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত রোভার্স পয়েন্ট প্রকৃতি ও পাখি প্রেমীদের কাছে যেন এক স্বর্গরাজ্য। নানা ধরণের জানা অজানা পাখীর দেখা মেলে এখানে। আর এই জন্যই একে ‘The Land of Unknown Birds’ বলা হয়।
তাশিগাও থেকে ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটা পাহাড়ি পাথুরে পথ লেপচাখা, ভুটান সীমান্ত থেকে মাত্র ৩ কিমি আগে। তাই সীমান্ত বাহিনীর চৌকি সর্বদা পাহারারত। লেপচাখা যখন পৌঁছালাম তখন বাজে ২ টো। পাহাড়ের উপর অনেকটা সমতল অঞ্চল জুড়ে এই গ্রাম। থাকার কয়েকটা ছোট ছোট হোমস্টে আছে। বেশ সুন্দর। পাশেই একটা ছোট্ট মনেস্ট্রি। আমার খুব ভালো লাগলো জায়গাটা।
অনেকটা পথ হেঁটে পেটে তখন ইঁদুর ডন দেওয়া শুরু করেছে। তাই আগে লাঞ্চ সেরে নিলাম। রোহনকেও আমার সাথে খেয়ে নিতে বললাম। ও বেচারারও খাওয়া হয়নি আমার পাল্লায় পরে। গরম গরম মাংস ভাত যেন অমৃত মনে হল।
পাহাড়ের উপর পাঁচটি পাহাড়ে ঘেরা একটি ছোট্ট সমলতলে অবস্থিত লেপচাখা। এখান থেকে পুরো ডুয়ার্সের অপরূপ ভিউ পাওয়া যায়। লেপচাখার এই অপরূপ রূপের জন্য একে অনেকে ‘ডুয়ার্সের রাণী’ বলে। অপরূপ সুন্দর এই গ্রামে দ্রুকপা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এরা আসলে ভুটানের আদিবাসিন্দা। শান্তি প্রিয় দ্রুকপারা বুদ্ধের উপাসক। এখানে এরা এক নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে যা নেপালি অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকা থেকে একদম আলাদা। এদের বাড়িঘর ও হোমস্টেগুলিও দ্রুকপা স্থাপত্যের আদলে তৈরি।
পাহাড়ের ধার ঘেঁষে সুন্দর ছিমছাম আমার ছোট্ট কাঠের ঘর। বারান্দায় বসে বসেই প্রকৃতির শোভা উপভোগ করা যায়। আমি ছাড়া এখন পর্যন্ত আজ আর কোন টুরিস্ট নেই এখানে। পাহাড়ের ঢাল আর ঘরের মাঝখানে কিছুটা খোলা জায়গা। আরেকপাশে আরেকটা হোমস্টে। পাহাড়ের ঢালের একদম ধারেই কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ। বিকেলে গিয়ে বসলাম ওখানে। সামনে দূরে পুরো বক্সা ফরেস্টটা যেন সবুজ গালিচার মত বিছিয়ে আছে। আর ওই সবুজের গায়ে জেগে আছে আলিপুরদুয়ার, জয়ন্তির ধুসর নদীগর্ভ, সান্তালাবাড়ী আর অজস্র ছোট বড় গ্রাম। আবহাওয়া ভাল থাকলে বক্সা ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া সাতটা নদী দেখা যায় এখান থেকে। আর লেপচাখার পেছনের দিকে অভিভাবকের মত দাড়িয়ে আছে মাহাকাল পাহাড়, চুনাভাট্টি আর রোভার্স পয়েন্ট। সূর্য তার বিদায়ের ব্যাথা মাখা লাল রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে আকাশ বাতাস। পড়ন্ত বিকেলের রদ্দুরে সামনের বিস্তীর্ণ ডুয়ার্সের জঙ্গল যেন আরও মোহমোয়ী হয়ে উঠেছে। এক অপূর্ব সুন্দর সূর্যাস্তের সাক্ষী করে সূর্য মনেস্ট্রির পতাকার ফাঁক দিয়ে হারিয়ে গেল। একটুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের ঢালে সন্ধ্যে নেমে এল। অন্ধকার নামতেই পাহাড়ের গায়ের গ্রামগুলো যেন এঁকে এঁকে জ্বলে উঠতে শুরু করলো। আকাশে ইতিমধ্যে বাঁকা চাঁদের হাসি ফুটেছে। টুক টুক করে জেগে উঠছে তারারা। সব মিলিয়ে আমার সামনে এক রহস্যময়ী প্রকৃতি। আর সেই রহস্যের মাঝে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ‘আমার আমি’। এরকম প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে পাই এক আশ্চর্য ঐশ্বরিক স্বত্বা যার মাঝে হারিয়ে যায় জীবনের সমস্ত গ্লানি, ক্লান্তি, হতাশা; আর মন ভরে ওঠে এক অবর্ণনীয় প্রশান্তিতে। কলেজে থাকতে Wordsworth এর একটা কবিতা (Lines Written a Few Miles above Tintern Abbey) পড়েছিলাম। সেদিন হয়তো তার গভীরতা বুঝিনি। আজ এই পাহাড় চূড়ায় আধুনিক নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন এক গ্রামে বসে উপলব্ধি করছি তার মর্মার্থ- এই প্রকৃতির মাঝেই রয়েছে সেই অতিমানবিক স্বত্বা যাকে আমরা খুঁজে বেড়াই মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়। যা মিলে মিশে আছে অস্ত যাওয়া সূর্যের কিরণে, নীল আকাশে, মুক্ত বাতাসে, পাহাড় চূড়ায়। আর আছে নিজের অন্তরে। তাঁকে খুঁজতে লাগে না- তাঁকে উপলব্ধি করতে হয়। যখন ‘আমার আমি’ ঘুমিয়ে পরে তখন সে জেগে ওঠে আর এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মন প্রান ভরিয়ে তোলে।
কতক্ষণ এরকম বসে ছিলাম মনে নেই, চমক ভাঙল পেছন থেকে আওয়াজে। ফিরে দেখলাম পাশের হোমস্টেটাতে একদল টুরিস্ট এল এখন। বাঙালীর স্বভাব, আলাপ জমে গেল সহজেই। এরা সবাই জলপাইগুড়িতে থাকে। দু’জন সবে চাকরী পেয়েছে আর সেটা celebrate করতেই ওদের এখানে আসা। রাতে এরা পিকনিক করবে। আমিও নেমন্তন্ন পেলাম তাদের পিকনিকে। কিন্তু সারাদিন হাঁটাহাঁটিতে একটু ক্লান্ত শরীর। বেশি রাত জাগার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না।
আজ তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে নিলাম। এখানে খাবারের বেশিরভাগ রশদই আনতে হয় সেই সান্তালাবাড়ি থেকে। তাই খাবারে খুব বেশি varity আসা করা যায় না। আজ ডিম ভাত দিয়েই ডিনার সারলাম। খেয়ে যখন ঘরে ফিরছি দেখলাম পাশের ঘরের সেই ছেলেগুলো ওদের ঘরের একটু দূরে কাঠ জড়ো করেছে। আগুন জ্বালাবার চেষ্টা চলছে। বলল, এখন তারা মাংস পোড়াবে। নেমন্তন্ন রক্ষায় তাদের সাথে একটু গল্প গুজব করেই ফিরে এলাম নিজের ঘরে। একটু আগের সেই অন্ধকার শান্ত স্নিগ্ধ জায়গাটা এখন এদের কলরবে মুখরিত, আলোকিত। এও এক অন্য রকম সুন্দর।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি মিস্টি আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। ঘরের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় খেলা করছে গ্রামের কয়েকটা বাচ্চা। মিস্টি হাওয়ায় দোলা দিচ্ছে মনেস্ট্রির পাশের সারি সারি দারচোর (Buddhist prayer flag, Darchor). বাতাসে ভাসছে মনেস্ট্রির ঘন্টার টুং টাং আওয়াজ।
ব্রেকফাস্ট সেরে ফিরতেই দেখি রোহন এসে হাজির। ওকে দেখে অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম- ‘কিরে তুই এখানে? স্কুল যাসনি?
-‘গেছিলাম তো। ফাদারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছি। বলেছি, আমার দিদি এসেছে, বিকেলে বন্ধুর কাছ থেকে সব পড়া দেখে আসবো। তাই ফাদার ছুটি দিয়েছে।’
উত্তর শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। এক অচেনা জায়গায় এক সদ্য পরিচিত কিশোরের সরল কথাগুলো আমাকে আবেগপ্রবণ করে দিল। ও চলে যাবার পর ওকে তো সেভাবে মনেও করিনি! অথচ ছেলেটি সকালে ৫ কিমি হেঁটে স্কুলে গিয়ে ছুটি নিয়ে আবার হেঁটে এই গ্রামে এসেছে আমার সাথে দেখা করতে। কি অদ্ভুত এই জীবন! নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হল। দু’জন মিলে চললাম চূণাভাটির পথে। রোহন আমার গাইড। ওদিকটাই নাকি ও অনেকবার গিয়েছে।
বক্সার জঙ্গলে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত আরেকটি ছোট্ট গ্রাম চূণাভাটি। বক্সাফোর্ট থেকে ৪ কিমি রাস্তা কিন্তু খুব খারাপ পাথুরে খাড়া পথ। ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। কিছু জায়গায় প্রায় হামাগুড়ি দিতে হয়। রোহন না থাকলে আমার পক্ষে অসম্ভম ছিল এ রাস্তায় চলা। তবে ট্রেকারদের কাছে এটি একটি পরিচিত নাম। এখনও পর্যটকদের ভিড়ে হারিয়ে যায়নি চূণাভাটির বন্য সৌন্দর্য। পথে দেখা পেলাম দুই পক্ষীবিদের সাথে যারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষীবিভাগ থেকে এসেছেন গবেষণার কাজে। ওনাদের থেকে জানলাম, এখানে অজস্র পাখির দেখা মিলে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Blue-winged Minla, Long-tailed Minivet, Black-faced Warbler, Black Eagle, Spangled Drongo, Blue-winged laughing Thrush, White-capped Redstart, Ashy-throated Warbler, White- vented Yuhinas, Black Bulbul.
পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত বাগান ঘেরা এই গ্রামের ছোট্ট থাকার জায়গাটিও দেখার মত সুন্দর। কোথাও গাছের ডালে ঝুলছে বুলবুলি পাখির বাসা আবার কোথাও ঝুলছে পাতা দিয়ে বানানো পিঁপড়ের বাসা। এক সুন্দর মন ভোলানো পাহাড়ি গ্রাম।
ফেরার সময় রোহন এর আব্দারে গেলাম ওদের বাড়ি। পাহাড়ের ধারে কাঠ ও টিনের তৈরি ছোট্ট দু’কামরার বাড়ি, সুপুরি গাছে ঘেরা। তিন ভাই আর বৃদ্ধ বাবার অভাবের সংসার। আলিপুরদুয়ারে এক দোকানে কাজ করে ওদের বাবা। সকালে বেড়িয়ে যান আর সন্ধ্যেবেলা ফিরেন। ভাইয়েরা পালা করে পড়াশুনোর সাথে সাথে সংসারের যাবতীয় কাজ, রান্নাবান্না সব করে। একটু দুরে বট গাছের ছায়ায় একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। ওখানেই গিয়ে বসলাম আমরা। পরিচয় হল পাড়ার আরও কয়েকজনের সাথে। দোকানের মাচায় বসে চা আর অমলেট খেতে খেতে শুনছিলাম ওদের পাহাড়ের জীবনযাত্রার কথা।
এখানে চাষবাস খুব একটা হয় না। জীবনধারণের সমস্ত রশদই এদের নিয়ে আসতে হয় সমতল থেকে। ইলেক্ট্রিক, মোবাইল টাওয়ার থাকলেও না থাকে ইলেক্ট্রিক, আর না পাওয়া যায় মোবাইলের টাওয়ার। আধুনিক সুযোগ সুবিধে থেকে বিছিন্ন এক জনপদ। সুবিধের মধ্যে পাড়ায় একটি মাত্র ছোট্ট মুদির দোকান হয়েছে এখন। তাও বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। কাজকাম, স্কুল মিলিয়ে দিনে দু’তিন বার সান্তালাবাড়ি যেতেই হয়। কখনও কখনও আরও বেশি। ভারী ভারী জিনিসপত্র নিচের বাজার থেকে বয়ে নিয়ে আসতে হয়। অসুখ বিসুখ হলে তো আর কথাই নেই। হঠাৎ মনে হল আমি যদি জাদু জানতাম তাহলে এখানের সবার দুঃখ দূর করে দিতাম এক পলকে! আমরা পাহাড়ে ঘুরতে আসি, দু’দিন ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে যাই নিজেদের চেনা জগতে। আর ফিরে গিয়ে সুন্দর সুন্দর গল্প শোনাই। কিন্তু এই পাহাড়ি সৎ মানুষগুলোকে ক’দিন মনে রাখি? এই পাহাড় থেকেই নিয়ে যাই অনেক স্মৃতি, অনেক ভালোলাগা। বদলে দিয়ে যায় না কিছুই। কেমন ইচ্ছে করলো যদি এদের মাঝে থেকে যেতে পারতাম, এদের সাথে এদের হয়ে লড়তাম! আদায় করে নিতাম বেঁচে থাকার নুন্যতম সুযোগ সুবিধাগুলো। কিন্তু এই ‘যদির’ দৌড় তো নদীতেই শেষ! তাই ভাবনার স্তর কেটে বেড়িয়ে এলাম বাস্তবে। ৭ দিনের ছুটি, আর তারপরই যোগ দিতে হবে সেই একঘেয়ে কাজে। ভাবনার অবকাশই নেই আর! নিজেকে বড় অসহায় লাগে। কারও জন্য কিছুই করতে পারলাম না এ জীবনে! জীবনটা বৃথা মনে হয়!
বিকেলবেলা রোহন আবার হাজির সদলবলে। আমার ঘরের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি শুরু করলো স্থানীয় বাচ্চাদের সাথে। কচিকাঁচাদের হুল্লোড়ে পুরো জায়গাটা মুখোরিত। ওরা চলে যেতেই পাহাড়ের ধারের কালকের সেই বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। এত শান্ত স্নিগ্ধ জায়গাটা যে কিছু না করে, শুধু বসে বসে, এর রূপ দেখেই যেন অনন্তকাল কাটিয়ে দেওয়া যায়। যারা কাল রাতে এসেছিল আজ দুপুরে তারা ফিরে গেছে। আজ এখানে আর কেউ নেই। সন্ধ্যের পরই পুরো নিস্তব্ধ চারপাশ। আকাশের দিকে তাকাতেই অবাক হলাম। এত পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ যেন আগে দেখিনি। তারা দেখা বা স্টার ট্রেলের ছবি তোলার জন্য লেপচাখা আদর্শ স্থান। তারাগুলোকে যেন বড় কাছে মনে হল। বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়লাম। মুগ্ধ হয়ে গেলাম তারাদের রূপে। ছোটবেলার বই এ পড়া কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডলরা একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল। আরও কত নতুন নতুন তারামন্ডলী চোখে পড়ল। কত নতুন নতুন আকার খুঁজে পেলাম। শৈশবের আবিষ্কারের আনন্দে মন ভরে উঠলো।
পরদিন আমার ফেরার পালা। সকাল বেলায় আবার রোহন এসে হাজির। আজ ছুটির দিন। তাই ওর স্কুল নেই। কিন্তু মন ভার তার। আমার সাথে সাথে সেও চলল সান্তালাবাড়ি পর্যন্ত। পাহাড়ে উঠতে যত সময় লাগে নামার সময় লাগে না। প্রায় অর্ধেকেরও কম সময়ে সান্তালাবাড়ি পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় অনেক জায়গায় দেখা পেলাম নানা ধরণের নানা রঙের প্রজাপতির।
আসার অটোটিকে আগেই বলা আছে, সেই নিতে আসবে আবার। হঠাৎ রোহন বলে উঠলো-
‘তোমার সাথে আর দেখা হবে না?’
-‘কেন হবে না? তুই কলকাতায় কখনও গেছিস? চলে আয় একবার। আমি তোকে কলকাতা শহর ঘুরিয়ে দেবো।’
কিছু না ভেবেই কাথাটা বলে ফেললাম। দেখলাম ওর চোখ দুটো আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
-‘আমি স্কুল পাস করে কলকাতায় কলেজে পরতে যাব। তখন তোমার কাছে থাকব।’
হেসে বললাম -‘নিশ্চয়!’
ও আরও উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল- ‘কিন্তু সে তো অনেক দেরি! আমার স্কুলের গরমের ছুটিতে তুমি এসো। তোমাকে আরও নতুন নতুন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবো।’
আমার গরমের ছুটির অন্য plan আগেই হয়ে গেছে, তাই কাটানোর সুরে বললাম, ‘আচ্ছা সে দেখা যাবে।’
দু’দিন ধরে ছেলেটা আমার সাথে ঘুরছে, কেমন যেন মায়া পরে গেছে। ৫০০ টা টাকা বের করে বললাম-
‘এটা রাখ। কিছু কিনে নিস!’
ও কিছুতেই টাকাটা নিলো না। আমার ব্যাগের কোনে টাকাটা গুজে দিয়ে বলল,
‘গরমের ছুটিতে তো আসছোই, তুমিই কলকাতা থেকে কিছু কিনে এনো আমার জন্য।’
কি বলব বুঝলাম না। মন ভারী হয়ে গেল। ‘গরমের ছুটিতেতো আসছোই’ কথাটা কত আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল। উত্তর নেই আমার কাছে। কেমন যেন বোবা হয়ে গেলাম।
আমার গাড়ী চলে এসেছে। ভার মনে উঠে বসলাম গাড়ীতে। রাস্তা বেঁকে যাবার আগে পর্যন্ত গাড়ীর কাঁচে দেখতে পেলাম রোহন গাড়ীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়… ব্যাগের পাশে গোঁজা টাকাটা চোখে পড়লো, টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছিলাম একটা পাহাড়ি কিশোরের আবেগ, ভালোবাসা। নিজেকে খুব ছোট লাগতে লাগলো। একটা কথাই কানে বাজতে লাগলো ‘গরমের ছুটিতে তো আসছোই!’…‘গরমের ছুটিতে তো আসছোই!’ যেন শুধু রোহন না, গোটা জয়ন্তি চিৎকার করে বলছে- ‘গরমের ছুটিতে তো আসছোই!’ বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। আর তখ্খনই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে, ঝাপসা করে দিল ‘বাহির-ভিতর’। গাড়ি এগিয়ে চলতে থাকল নিজের গতিতে, নিজের পথে।
কিভাবে যাবেনঃ কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ার ট্রেনে। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা অটো করে সান্তালাবাড়ি/ সান্ত্রাবাড়ি। সেখান থেকে বক্সাফোর্ট ৫ কিমি। জঙ্গলে ঢোকার মুখে গার্ড আছে। সেখানে খাতায় entry করে গাইড নিয়ে ঢুকতে হয়। সান্তালাবাড়ি থেকে রোভার্স পয়েন্ট- রূপমভ্যালী ট্রেকও (১৪ কিমি) করা যায়।
বক্সাফোর্ট থেকে আরও ৫ কিমি লেপচাখা। ফোর্ট থেকে সরাসরি রোভার্স পয়েন্ট যাওয়ার রাস্তা আছে। দূরত্ব ৩ কিমি। আর চুনাভাটি ৪ কিমি।
কোথায় থাকবেনঃ
সান্তালাবাড়িতে থাকার জায়গা- বক্সা ভ্যালী রিসোর্ট,
বক্সাফোর্টের এর কাছে- রোভার্স ইন (Rover’s Inn) হোমস্টে। ফোঃ ইন্দ্র শঙ্কর থাপা +91 91972 06414, হিলটপ হোটেল– ফোঃ +91 83459 52969, বক্সা হিল ফরেস্ট বাংলো, বক্সা হিল ফরেস্ট, যোগাযোগ- ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর, বক্সা টাইগার রিসার্ভ আলিপুরদুয়ার কোর্ট ফোঃ 03564 256005.
লেপচাখাতে থাকার জায়গা- লেপচাখা, হেভেন অফ ডুয়ার্স হোমস্টে, ফোঃ +91 96141 47795
ফেসবুক থেকে এই লিঙ্ক এ এসে… একটা দারুন লেখা পরলাম… আমি ও একা ঘুরতে ভালবাসি… লেখা হয়ে ওঠে না… খুব ভাল লাগলো… আমি বাংলা পড়িনি … ভুল থাকতে পারে এই লেখায়… আরো লেখা পড়ার ইচ্ছে রইল… এই ভাভে ঘুরে বেড়ান আর… লিখে যান…
ধন্যবাদ। এইভাবেই পাশে থাকুন আর আপনিও অনেক অনেক ঘুরে বেড়ান!!