জানুয়ারির অসহ্য ঠান্ডায় যখন প্রায় জমে যাই তখন খুব ইচ্ছে করে কয়েকদিনের জন্য টুক করে গরম কোনো জায়গায় পালিয়ে যাই । এরকমই এক কনকনে ঠান্ডায় পালিয়ে গেছিলাম দূর দেশের এক ছোট্ট দ্বীপে। আটলান্টিকের গাঢ় নীল জলরাশিতে ঘেরা সে এক অদ্ভুদ দ্বীপ। সেখানে সমুদ্র , পাহাড়, সোনালী বালিয়ারি মিলেমিশে তৈরী করেছে এক স্বপ্নরাজ্য। নাম ‘গ্রান কানারিয়া’। এটি স্পেনের কানারি দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত একটি দ্বীপ। প্রকৃতি খুব যত্ন নিয়ে গড়েছে গ্রান কানারিয়াকে। অদ্ভুত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য চোখে পরে একসাথে। আর তার জন্যই এই দ্বীপ “পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্করণ” নামে খ্যাত।



আমরা উঠেছিলাম সান অগাস্টিন বীচের কাছে এক সুসজ্জিত হোটেলে। বারান্দা দিয়ে হাতছানি দেয় আটলান্টিকের অপূর্ব ঘন নীল জলরাশি। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল পেরিয়ে গেলেও ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে পরলাম। ঘুরে এলাম বীচের ধারের বাজার। অজস্র দোকানের আলোর ঝরনাধারায় চারপাশ দিনের মত উজ্জ্বল, ঝকঝকে।



আমাদের প্রথম গন্তব্য রক নুবলো। এটি গ্রান কানারিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড়। আসলে এটি ৮০ মিটার উঁচু এক আগ্নেয় শিলা। এর চূড়াটি সমুদ্রপ্রিষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০০ মিঃ উপরে। পৃথিবীর উচ্চতম free standing শিলার মধ্যে এটি অন্যতম। প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে লাভা জমে এটি তৈরী হয়। একে এই দ্বীপের একটি প্রাকৃতিক স্তম্ভ বলে মানা হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে সূর্য দেবতাকে নৈবদ্য উৎসর্গ করার একটি পবিত্র স্থান এটি। লা গোলেটা থেকে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটা পথ। কানারিয়ান পাইন গাছে ঢাকা খাঁড়া পাথুরে রাস্তা বেয়ে পৌঁছতে হয় রক নুবলোর পাদদেশে। এখান থেকে মেঘে ঢাকা আরতেনারা, পশ্চিম গ্রান কানারিয়া ও আটলান্টিকের সুনীল জলরাশিতে ঘেরা তেনেরিফে দ্বীপে অবস্থিত স্পেনের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তেইদের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়।






আমাদের তৃতীয় দিনের গন্তব্য ছিল Palmitos Park। পাহাড় দিয়ে ঘেরা ২০ হেক্টর জমির উপর তৈরী হয়েছে এই Botanical Garden ও পক্ষিশালাটি। প্রায় ২৫০ প্রজাতির অসংখ্য পাখি দেখা যায় এখানে। আছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় Butterfly Garden, আছে নানা প্রজাতির সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রানী। এদের cactus garden এ আছে ১৫০ এরও বেশি প্রজাতির Cactus. কিন্তু যার জন্য এই পার্কটি বিখ্যাত তা হচ্ছে এখানের Dolphin Show. বাজনার তালে তালে dolphin দের অদ্ভুদ খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চাইলে ডলফিনের পিঠে চেপে ঘোরার ব্যবস্থাও আছে। এরপর ডলফিনদের টাটা জানিয়ে চলে গেলাম Parrot Show দেখতে। মজার মজার গল্পের সাথে মজার মজার খেলা। বাচ্চাদের জন্য আদর্শ সথান। এরপর আছে শিকারি পাখির খেলা। খেলা শেষে পুরো পার্কটা ঘুরে যখন বের হলাম দেখলাম সারাদিন কেমন নিমেষে কেটে গেছে।



আমরা ফেরার সময় মেলোনেরাস বীচ ঘুরে ফিরলাম। এটি গ্রান কানারিয়ার বিখ্যাত Nudist Beach. বীচের ধারে নানা ধরনের খাবারদোকান আছে। এখানের প্রায় সব দোকানের খাবারই খুব সুস্বাদু। আমরা স্পেনের বিখ্যাত খাবার Paella (পায়েয়া) খেয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
চতুর্থ দিনটি পুরো রাখা ছিল Beach Activity এর জন্য। তাই আমরা সক্কাল সক্কালই চলে গেলাম Playa de Inglishe তে। এখানে নানা ধরনের Water Sports এর ব্যবস্থা আছে। আমরা Parasailing করলাম। রঙ্গিন Parachute করে আটলান্টিকের উপর নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো এক অদ্ভুদ অভিজ্ঞতা। এরপর করলাম Banana Boating. ছোটবেলার বন্যার সময় কলাগাছের ভেলায় করে ভেসে বেড়ানোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। শুধু বোটটা বন্যার জলে নয়, ভাসছে আটলান্টিকের বুকে। বেশ মজাই লাগছিল। সবশেষে Jet Ski করলাম। ঢেউ এর তালে তালে খোলা সমুদ্রে জেট স্কির মজাই আলাদা। সেদিন প্রচণ্ড বাতাস থাকায় খুব বড় বড় ঢেউ এ আমাদের পুরো ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। ভালোলাগা, ভয় সব মিলিয়ে এক শিহরন জাগানো অভিজ্ঞতা।









পরের দিনের প্রথম গন্তব্য কালেদ্রা বান্দামা। এটি একটি Volcanic Crater. ২০০ মি গভীরে বান্দামার তলা পর্যন্ত পৌঁছানোর পায়ে হাঁটা রাস্তা আছে। খাঁড়া এই রাস্তা দিয়ে গেলে অনেক প্রাকৃতিক গুহা চোখে পরে যেগুলো স্থানীয় আদিবাসীরা শস্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করে। আছে নানা প্রজাতির গাছ। তলা পর্যন্ত পৌঁছালে দেখা যায় আদিম মানুষের ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। আর তার পাশেই গুহার ভেতর আদিবাসীদের কবর দেওয়া হয়।



পরবর্তী গন্তব্য Arucas. Las Palmas এর পাশেই ছোট্ট সাজানো শহর Arucas বিখ্যাত তার সুন্দর সাজানো বাগান আর Parish Church Of San Juan Bautista এর জন্য। প্রাচীন স্থাপত্যের প্রতীক এই চার্চটি তৈরী হয়েছে Arucas পাথর দিয়ে।
ষষ্টদিনের সকালটা রাখা ছিল scuba diving এর জন্য। প্রথমে scuba centre এ শুরু হল আমাদের training. জলের তলায় কিভাবে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া যায় শেখানো হল। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হল খোলা সমুদ্রে- Playa de Arinaga তে। এটি এখানের একটি বিখ্যাত diving site. আমরা dive এর পোশাক পরে oxygen cylinder পিঠে বেঁধে নেমে পরলাম জলে। পরিচয় হল জলের তলার এক অন্যজগৎ এর সাথে। ঝকঝকে পরিস্কার জল। চারিপাশে ঘোরাফেরা করছে রঙবেরঙের মাছ। আমাদের ছুঁয়েই পালিয়ে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক লাল নীল মাছের দল। কত ধরনের জলের তলার গাছ, শ্যাওলা ঢেউ এর তালে তালে যেন নাচ করছে। জলের ভিতর ঠিকরে পরছে সূর্যের রশ্মি। চরিপাশে যেন মনিমুক্তোর চমক। রঙবেরঙের কোরাল বিছানো সমুদ্রতল।সব মিলিয়ে যেন কল্পনায় দেখা জগৎ। ছোটবেলার টিভিতে দেখা জলপরীদের রাজ্যের মতই সুন্দর, স্বপ্নময়।



এরপর আমরা মাসপালোমোসের বীচে ঘুরে বেড়ালাম। ঘন নীল জল আর সোনালী বালি বিছানো এই বীচ। সারি সারি সাজানো আছে সানবেড। অনেকেই কাইটবোর্ডিং করছে । আর বীচের কাছেই আছে সোনালী বালিয়াড়ি যার জন্য বিখ্যাত এই বীচ।









এই ক’দিনে প্রকৃতিকে নানা রূপে আবিষ্কার করেছি। আর প্রতি রূপেই আমায় মুগ্ধ করেছে গ্রান কানারিয়া। জীবনে কত সময় আসে আবার হারিয়েও যায় সময়ের সাথে সাথে। থেকে যায় শুধু স্মৃতিরা। আর গ্রান কানারিয়ায় কাটানো মুহূর্তরা এক অন্যরকম স্মৃতি যারা তারা হয়ে জ্বলে ওঠে আলো দেয় মনখারাপের সাঁঝবেলায়।
Recent posts:
- দুয়ারসিনি.. (Duarsini, a Hamlet near Ghatshila)June 15, 2021/0 Comments
- ছোট্ট ছুটিতে পেডং (Pedong- Weekend Gateway)October 27, 2020/
- জলদাপাড়ার দু’রাত্রি…(Holong Forest Bungalow, Jaldapara)November 5, 2019/